১৯৭৯ সালের এপ্রিল মাসে Taxation Enquiry Commission (TEC) আনুষ্ঠানিকভাবে সেলস ট্যাক্স এর বিকল্প হিসেবে মূল্য সংযোজন কর ব্যবস্থা চালুর প্রস্তাব করে। ১৯৮২ সাল পর্যন্ত The Sales Tax Act, 1951 এর আওতায় সেলস ট্যাক্স আদায় করা হতো, যা পরবর্তীতে ১ জুলাই, ১৯৮২ হতে জারিকৃত The Sales Tax Ordinance, 1982 এর আওতায় আদায় করা হতো। বাংলাদেশে ভ্যাট ব্যবস্থা প্রবর্তনে বিশ্বব্যাংক অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ১৯৮৬ সালের ডিসেম্বরে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে কর ব্যবস্থার সংস্কারের ওপর এটি প্রস্তাবনা তৈরি করে। ১৯৮৯ সালের ১৫ অক্টোবর তারা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। এ রিপোর্টে আগামী তিন বছরের মধ্যে আমদানি ও উৎপাদন পর্যায়ে এক হার বিশিষ্ট ভ্যাট ব্যবস্থা প্রবর্তনের সুপারিশ করা হয়। ১৯৮৯ সালের ১৩ নভেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিদল ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ড ভ্রমণ করে। প্রতিনিধিদল ১৯৯০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রতিবেদন প্রদান করে। এ সময় ভ্যাট ব্যবস্থা চালুর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সময়ে সময়ে এফবিসিসিআইসহ শীর্ষস্থানীয় বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংগঠনের সাথে আলোচনা করা হয়। সরকার খসড়া মূল্য সংযোজন কর আইন, ১৯৯০ জুন মাসে তৈরি করে। ৩১ মে ১৯৯১ সালে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে আট অধ্যায় বিশিষ্ট আইনটি জারি করা হয়, যা ২ জুন, ১৯৯১ থেকে কার্যকর করা হয়। অধ্যাদেশের আটটি ধারা (যেগুলো মূসক পদ্ধতিতে নিবন্ধিত হওয়া এবং মূসক কর্তৃপক্ষের নিয়োগ ও ক্ষমতা সংক্রান্ত ছিল) ২ জুন, ১৯৯১ থেকে এবং বাকি ধারাগুলো ১ জুলাই, ১৯৯১ থেকে কার্যকর করা হয়। মহান জাতীয় সংসদে ১ জুলাই, ১৯৯১ সালে মূল্য সংযোজন কর বিল, ১৯৯১ উত্থাপিত হয় এবং তা ৯ জুলাই, ১৯৯১ সালে পাস হয়। ১০ জুলাই, ১৯৯১ থেকে তা কার্যকর করা হয়। এ আইনটি The Business Turnover Tax Ordinance, 1982 & The Sales Tax Ordinance, 1982 কে প্রতিস্থাপিত করে। ফলে ১৯৯১ সালে আমদানি ও উৎপাদিত পণ্যের সরবরাহের ক্ষেত্রে ১৫% হারে ভ্যাট আহরণ শুরু হয়। মূসক আইন জারির মাধ্যমে:
ক. ১ জুলাই ১৯৯১ থেকে কারবারি টার্নওভার কর অধ্যাদেশ, ১৯৮২ এবং বিক্রয় কর অধ্যাদেশ, ১৯৮২ বাতিল করা হয়:
খ. ১৯৯১-৯২ সালে করযোগ্য দ্রব্যের আমদানিকারক বা সরবরাহকারী (উৎপাদক) এবং করযোগ্য সেবা প্রদানকারীর বার্ষিক বিক্রয়ের পরিমাণ ৫ লাখ টাকা বা তার বেশি হলে তার ওপর ১৫% হারে মূসক আরোপ করা হয়;
গ. করযোগ্য দ্রব্যের সরবরাহকারী বা করযোগ্য সেবা প্রদানকারীর বার্ষিক বিক্রয়ের পরিমাণ ১৫ লাখ। টাকার কম হলে ২% হারে টার্নওভার কর আরোপ করা হয়:
ঘ. নতুন আইন অনুযায়ী যেকোনো দ্রব্য বা সেবার রপ্তানির ক্ষেত্রে শূন্য হারের মূসক আরোপ করা হয়:
ড . আবগারি শুন্তের আওতা খুবই নিম্নপর্যায়ে নিয়ে আসা হয় এবং আবগারি শুল্কযোগ্য দ্রব্য ও সেবাসমূহকে মুসকের আওতায় স্থানান্তর করা এবং চ. বিলাস দ্রব্য ও আবশ্যক নয় এবং সামাজিকভাবে অনভিপ্রেত দ্রব্য বা সেবার ওপর ১০-৮৫% হারে
সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়।
বাংলাদেশে ভ্যাট ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য চারটি কারণ চিহ্নিত করা হয়, কারণগুলো হলো-
ক. কর ব্যবস্থায় পৌনঃপুনিকতা। করা,
খ. কর প্রশাসনে স্বাচ্ছতা আনয়ন,
গ. রাজস্ব প্রশাসনকে সুসংহত করা,
ঘ. অভ্যন্তরীণ সম্পদ সঞ্চালনের মাধ্যমে অর্থনীতিকে সক্রিয় করা,
৩. কর-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধি করা।
১ জুলাই ১৯৯১ চালু হওয়া মূসক হলো প্রাথমিকভাবে একধরনের ভোগ কর (মূলধনী দ্রব্যের ক্রয়কে উপকরণ হিসেবে অনুমোদন করার মাধ্যমে), যার ব্যাপ্তি ছিল আমদানি, উৎপাদন বা প্রস্তুতকরণ এবং সেবা প্রদান পর্যায় পর্যন্ত। সেক্ষেত্রে রপ্তানি (যা ছিল শূন্য করহারের), পাইকারি ও খুচরা পর্যায় কর-বহির্ভূত ছিল। ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছর থেকে বাংলাদেশে প্রচলিত মূসক পাইকারি ও খুচরা পর্যায়কে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে একটি ব্যাপকভিত্তিক ভোগব্যয় কর-এ পরিণত হয়েছে। যে সমস্ত পণ্য ও সেবার ওপর মূসক আরোপ করা হয় তা হলো। জারিকৃত মূসক অধ্যাদেশের প্রথম তফসিলে উল্লেখিত পণ্য ছাড়া আমদানিকৃত সকল পণ্যের ওপর, মূসক অধ্যাদেশের তফসিলে উল্লেখিত পণ্য ছাড়া দেশে সরবরাহকৃত সকল পণ্যের ওপর, জারিকৃত মুসক অধ্যাদেশের দ্বিতীয় তফসিলে উল্লেখিত সেবা ছাড়া বাংলাদেশের সকল সেবা খাতে। শুরুতে ১৯৯১- ৯২ অর্থবছরে সম্পূরক শুন্ধহারের সংখ্যা ছিল ৫টি (সর্বনিম্ন ১০%, সর্বোচ্চ ৮৫%)।
দক্ষিণ এশিয়ায় কর-স্কুল দেশজ উৎপাদ অনুপাত এমনিতে কম, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থা আরো নাজুক। বাংলাদেশের কর-স্কুল দেশজ উৎপাদিত পণ্যের অনুপাত ৯৪-এর সামান্য বেশি, যা দক্ষিণ এশিয়ার গড় ১১%, উন্নয়নশীল দেশসমূহের গড় ১৫%, শিল্পায়িত দেশসমূহের গড় ৩০% ও উচ্চ আয়সম্পন্ন দেশসমূহের গড় ২৪%-এর চেয়ে কম। মুসক প্রবর্তনের ফলে বাংলাদেশের কর রাজস্ব সংগ্রহ তথা কর-স্কুল দেশজ উৎপাদন অনুপাত তাৎপর্যপূর্ণভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৯০-৯১ অর্থবছরে মোট আদায়কৃত বিক্রয় কর এবং আবগারি শুভের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৫ শত ৫০ কোটি টাকা (২৫.৫ বিলিয়ন টাকা)। মূসক চালুর প্রথম বছরে (১৯৯১-৯২) মূসক ও আবগারি শুল্ক একত্রে আদায়ের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ১ শত ৪০ কোটি টাকা (৩১.৪ বিলিয়ন টাকা) যা পূর্ববর্তী বছরের বিক্রয় কর ও আবগারি শুভের চেয়ে ২৩.৩% বেশি এবং মূসক অধ্যাদেশের আওতায় আদায়কৃত কর ও আবগারি শুল্ক একত্রে ৩ হাজার ১ শত ৯০ কোটি টাকা (৩১.৯ বিলিয়ন টাকা) যা পূর্ববর্তী বছরের বিক্রয় ও আবগারি শুন্ধের তুলনায় ২৫.৩% বেশি। মূসক প্রবর্তনের পূর্বে পাঁচ বছরে (১৯৮৬-৮৭ থেকে ১৯৯০-৯১) আদায়কৃত করের বিক্রয় কর ও আবগারি শুভের অংশ ছিল গড়ে ৩৮.৯%। মূসক প্রবর্তনের পরে মূসক আইনের আওতায় (মূসক, এস.ডি ও টি.টি) সামগ্রিকভাবে কর আদায়ের পরিমাণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। ১৯৯১-৯২ থেকে ১৯৯৫-৯৬ সময়কালে আদায়কৃত করের মধ্যে শুধু মুসকের অংশ ছিল ২৮.৫% এবং মূসক আইনে মোট করের (মূসক, এস.ডি ও টি.টি) অংশ ছিল গড়ে ৩৯.৮%। ২০০৬-২০০৭ থেকে ২০০৯-১০ সময়কালে গড়ে এই হার শুধু মুসকের ক্ষেত্রে ছিল ৩৫.৭% এবং মূসক এ.ডি ও টি.টির অংশ ছিল ৫১.৭%।
টাকার অঙ্কে মুসক ও আবগারি শুঙ্কের যৌথ বার্ষিক বৃদ্ধি পূর্বের বিক্রয় কর ও আবগারি শুদ্ধের যৌথ বার্ষিক বৃদ্ধির তুলনায় অনেক বেড়েছে। কিন্তু আপেক্ষিক বিচারে আশির দশকে মোট করের শতাংশ হিসেবে বিক্রয় কর ও আবগারি শুন্ধের পরিমাণ মূসক চালুর পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত মোট করের শতাংশ হিসেবে মূসক ও আবগারি শুত্তের পরিমাণ মোটামুটি একই ধরনের। বিভিন্ন নির্দেশ-এর (অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য কর, বৈদেশিক বাণিজ্য কর, পরোক্ষ কর, মোট কর, মোট স্কুল দেশজ উৎপাদ এবং অ-কৃষিজ স্কুল দেশজ উৎপাদ) শতকরা হিসেবে মূসকের হার ক্রমবর্ধনশীল এবং শতকরা হারও লক্ষণীয়। গড়ে মোট করের ৭৫% ভাগ (২০০৯-১০ সালের বাজেটে ৭০%) আসে পরোক্ষ কর থেকে, আবার পরোক্ষ করের অর্ধেকেরও বেশি আসে মূসক থেকে (২০০৯-১০ সালের বাজেটে ২২৭.৯ বিলিয়ন টাকা লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, যা আদায়যোগ্য করের ৫০.২%)। অ-কৃষি খাতই হলো প্রধানত মূসকের অধীন, কিন্তু ১৫% প্রমাণ করহারে মুসক অ-কৃষিজ স্কুল দেশজ উৎপাদের মাত্র ৩-৪%।
বাংলাদেশে মূসক চালু করা হয়েছে কর-ভিত্তি (বা মূল্য সংযোজন) নির্ণয়ের সময় উৎপাদন মূল্য (করযোগ্য দ্রব্য ও সেবার বিক্রয়লব্ধ অর্থ) থেকে মূলধনী দ্রব্যের পূর্ণ মূল্য উপকরণ হিসেবে বাদ দেওয়ার অনুমোদন দিয়ে এবং এ কারণে মূসক একটি ভোগ কর। যদিও মূসকের প্রাথমিক আওতা ছিল আমদানি ও উৎপাদন পর্যায় পর্যন্ত, তবে ১৯৯৬-৯৭ থেকে মূসক নেটওয়ার্ক পাইকারি ও খুচরা পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত। জুলাই ২০১০ সালের তথ্য অনুযায়ী মুসক আরোপযোগ্য সেবার সংখ্যা হলো ২৯ (২৪টি শিরোনামা সংখ্যার অধীনে), কিন্তু বর্তমানে এ সংখ্যা তত্ত্বীয়ভাবে অসীম, যদিও ব্যবহারিক উদ্দেশ্যে মূসক আরোপের জন্য ৭১টি শিরোনামা সংখ্যার অধীনে ৯৩টি সেবার আওতা সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে (জুলাই ২০১০)। মূসক আইনের প্রথম তফসিলে তালিকাভুক্ত প্রাথমিক অপ্রক্রিয়াজাত কৃষিজ দ্রব্য ও খাদ্যদ্রব্যকে (জীবন্ত প্রাণী বা হাঁস-মুরগি, মানুষের বা প্রাণীর চুল, প্রাণীর অঙ্গের অংশ, প্রাণিজ দ্রব্য, গাছের অংশ, কাঁচা বা শুষ্ক শাকসবজি, ফল, অপ্রক্রিয়াজাত মসলা, খাদ্যদ্রব্য, তৈলবীজ, প্রাকৃতিক আঠা বা ওই ধরনের দ্রব্য, কাঠ, অপরিষ্কৃত উল বা তুলা এবং কাঁচা পাট) শুধু মূসকের আওতা-বহির্ভূত রাখা হয়েছে। ফলে প্রায় সমগ্র অর্থনীতি এখন মূসক নেটওয়ার্কের আওতাভুক্ত এবং আশা করা হয়, ভোগ-কর হিসেবে মূসক অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে সুশৃঙ্খল করবে। সম্পূরক শুল্ক আরোপের মাধ্যমে উক্ত শৃঙ্খলা অর্জনের ক্ষেত্রে আরো সংশোধনী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
গড় রাজস্ব আয়ের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ১৯৮২-১৯৯১ অর্থবছর পর্যন্ত ১৩.৮ শতাংশ। ১৯৯২-২০০১ পর্যন্ত সময়ে এটি ১১.৮০ শতাংশে নেমে আসে। কিন্তু ২০০২-২০১০ পর্যন্ত সময়ে গড় প্রবৃদ্ধি হয় ১৪.২০ শতাংশ।