অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল করার সম্পূর্ণ গাইড (২০২৫)
"A Comprehensive Overview of the 2025 Online Income Tax Return Filing Process in Bangladesh"
ভূমিকা (Introduction)
বর্তমান ডিজিটাল বাংলাদেশে সরকার আয়কর ব্যবস্থাকে আরও সহজ ও স্বচ্ছ করার লক্ষ্যে অনলাইন রিটার্ন দাখিল প্রক্রিয়া চালু করেছে। এখন ঘরে বসেই আপনি অনলাইনে আয়কর রিটার্ন (Online Income Tax Return) জমা দিতে পারেন — কোনো ঝামেলা ছাড়াই। এই আর্টিকেলে আমরা আলোচনা করব কীভাবে আপনি ধাপে ধাপে আয়কর রিটার্ন দাখিল করবেন, কোন কাগজপত্র প্রয়োজন হবে, এবং কীভাবে ভুল এড়ানো যায়।
আয়কর রিটার্ন কী?
আয়কর রিটার্ন (Income Tax Return) হচ্ছে একটি বিবরণী যেখানে আপনি সরকারকে জানান আপনার নির্দিষ্ট অর্থবছরে কত আয় হয়েছে এবং সে অনুযায়ী কত কর দিয়েছেন বা দিতে হবে। এটি দাখিল করা প্রত্যেক করদাতার আইনি বাধ্যবাধকতা।
কে কে আয়কর রিটার্ন দাখিল করবেন?
যাদের বার্ষিক আয় নির্ধারিত কর-মুক্ত সীমার উপরে
যাদের TIN (Tax Identification Number) আছে
কোম্পানি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ফার্ম
যারা কর ছাড়ের সুবিধা নিতে চান
যারা ভিসা বা ঋণের জন্য ইনকাম প্রুফ প্রয়োজন
অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিলের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র
ই-টিআইএন (e-TIN) নম্বর
জাতীয় পরিচয়পত্র (NID)
মোবাইল নম্বর ও ইমেইল
ব্যাংক স্টেটমেন্ট (যদি প্রযোজ্য)
ব্যবসা বা চাকরির আয় সংক্রান্ত তথ্য
ব্যয়ের বিবরণ
বিনিয়োগের বিবরণ (যেমন: সঞ্চয়পত্র, লাইফ ইনস্যুরেন্স)
কর রেয়াত সংক্রান্ত তথ্য
ধাপে ধাপে অনলাইন আয়কর রিটার্ন দাখিলের পদ্ধতি
Step 1: আয়কর বোর্ডের ওয়েবসাইটে রেজিস্ট্রেশন
প্রথমে e-Return ওয়েবসাইটে প্রবেশ করুন।
নতুন ইউজার হলে:
Register অপশনে ক্লিক করুন
ই-টিআইএন, মোবাইল নম্বর দিন
একটি পাসওয়ার্ড সেট করুন
OTP ভেরিফিকেশন সম্পন্ন করুন
Step 2: লগইন করে ড্যাশবোর্ডে প্রবেশ
ইউজারনেম ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন
ড্যাশবোর্ড থেকে “Return Submission” অপশন সিলেক্ট করুন
Step 3: ফরম পূরণ (ITR ফর্ম)
অনলাইন রিটার্ন ফর্ম ৩টি অংশে ভাগ:
ব্যক্তিগত তথ্য (Personal Info)
আয় ও ব্যয়ের বিবরণ (Income & Expense)
কর রেয়াত, কর প্রদানের তথ্য (Tax Credit & Payment Info)
টিপস:
চাকরিজীবীদের জন্য বেতন সংক্রান্ত তথ্য ইনপুট দিতে হয়
ব্যবসার ক্ষেত্রে বিক্রয় ও লাভ-ক্ষতির হিসাব দিতে হয়
Step 4: দলিলপত্র আপলোড করার প্রয়োজন নেই, (এগুলি সংরক্ষণ করুন ভবিষ্যৎ এর জন্য)
যেমন:
ব্যাংক স্টেটমেন্ট
ইনভেস্টমেন্ট প্রমাণ
সার্টিফিকেট অব ইনকাম
Step 5: রিটার্ন রিভিউ ও সাবমিট করুন
পূরণ করা তথ্য আবার দেখে নিন
“Submit” অপশনে ক্লিক করুন
একটি Acknowledgement Number পাবেন
PDF কপি ডাউনলোড করে সংরক্ষণ করুন
অনলাইন রিটার্নের শেষ সময়সীমা
প্রতি বছর ৩০ নভেম্বর এর মধ্যে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হয়। দেরিতে জমা দিলে জরিমানা ও সুদ ধার্য হতে পারে।
অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিলের সুবিধাসমূহ
ঘরে বসেই দাখিলের সুযোগ
সময় ও খরচ বাঁচে
সহজে রেকর্ড রাখা যায়
ভবিষ্যতের জন্য ইনকাম প্রুফ তৈরি হয়
বিভিন্ন ধরণের আয়কর রেয়াত যা পাওয়া যায়
লাইফ ইনস্যুরেন্স প্রিমিয়াম
সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ
পেনশন স্কিম
রিটার্ন দাখিলের কর পরিশোধ (যদি বকেয়া থাকে)
যদি আপনার হিসাব অনুযায়ী কর বকেয়া থাকে, তাহলে
চালান তৈরি করুন
নির্ধারিত ব্যাংকে বা মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাপে পরিশোধ করুন
চালানের কপি রিটার্নের সঙ্গে সংযুক্ত করুন
সার্টিফিকেট বা রসিদ ডাউনলোড
রিটার্ন সফলভাবে সাবমিট করার পরে আপনি একটি Acknowledgement Receipt এবং পরবর্তীতে Tax Clearance Certificate ডাউনলোড করতে পারবেন।
অনলাইন রিটার্ন সম্পর্কিত সাধারণ প্রশ্নোত্তর (FAQs)
eTIN ছাড়া কি অনলাইনে রিটার্ন দেয়া যাবে?
না, eTIN ছাড়া রিটার্ন দাখিল করা যাবে না।
মোবাইল দিয়েও কি রিটার্ন দেয়া যাবে?
না, স্মার্টফোন ব্যবহার করে ওয়েবসাইটে গিয়ে রিটার্ন দাখিল এর সকল option পাওয়া যাবে না।
রিটার্ন দিলে কর দিতে হবে?
যদি কর প্রযোজ্য না হয়, তাহলে শুধুমাত্র রিটার্ন ফাইল করলেই হবে। টাকা দিতে হবে না।
সহায়তার জন্য কোথায় যোগাযোগ করবো?
স্থানীয় কর অফিস
আয়কর হেল্পলাইন: 09643717171
ব্যক্তি করদাতার ন্যূনতম কর ?
বর্তমানে বাংলাদেশের আয়কর আইনের অধীনে ব্যক্তি করদাতাদের জন্য নূন্যতম কর নির্ধারিত হয় করদাতার অবস্থান (অর্থাৎ তারা কোন অঞ্চলে বাস করেন) এবং আয়ের ওপর ভিত্তি করে। নিচে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ব্যক্তিগত করদাতাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ন্যূনতম করের তথ্য দেওয়া হলো:
অঞ্চল | ন্যূনতম কর (টাকা) |
---|---|
ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন | ৫,০০০ টাকা |
অন্যান্য সিটি কর্পোরেশন | ৪,০০০ টাকা |
সিটি কর্পোরেশন ছাড়া অন্যান্য এলাকা | ৩,০০০ টাকা |
সাধারণ ব্যক্তি করদাতা স্ল্যাব, কর হার ?
বাংলাদেশে ব্যক্তি করদাতার জন্য আয়কর হার নির্ধারিত হয় তাদের বার্ষিক আয়ের উপর ভিত্তি করে, যা স্ল্যাব ভিত্তিক। নিচে ২০২৪–২০২৫ অর্থবছরের জন্য সব ধরনের ব্যক্তি করদাতার কর হার দেওয়া হলো:
সাধারণ ব্যক্তি করদাতা (পুরুষ, ৬৫ বছরের নিচে)
বার্ষিক আয় (৳) | কর হার |
---|---|
৩,৫০,০০০ পর্যন্ত | ০% |
পরবর্তী ১,০০,০০০ | ৫% |
পরবর্তী ৪,০০,০০০ | ১০% |
পরবর্তী ৫,০০,০০০ | ১৫% |
পরবর্তী ৫,০০,০০০ | ২০% |
পরবর্তী ২০,০০,০০০ | ২৫% |
অবশিষ্ট মোট আয়ের উপর ৩০%
মহিলা ও ৬৫ বছরের বেশি বয়সী করদাতা
বার্ষিক আয় (৳) | কর হার |
---|---|
৪,০০,০০০ পর্যন্ত | ০% |
পরবর্তী ১,০০,০০০ | ৫% |
পরবর্তী ৪,০০,০০০ | ১০% |
পরবর্তী ৫,০০,০০০ | ১৫% |
পরবর্তী ৫,০০,০০০ | ২০% |
পরবর্তী ২০,০০,০০০ | ২৫% |
অবশিষ্ট মোট আয়ের উপর ৩০%
প্রতিবন্ধী ব্যক্তি
বার্ষিক আয় (৳) | কর হার |
---|---|
৪,৭৫,০০০ পর্যন্ত | ০% |
এরপর আয় স্ল্যাব অনুযায়ী | উপরের মতো |
মুক্তিযোদ্ধা (যুদ্ধাহত)
বার্ষিক আয় (৳) | কর হার |
---|---|
৫,০০,০০০ পর্যন্ত | ০% |
এরপর আয় স্ল্যাব অনুযায়ী | উপরের মতো |
🔹 উদাহরণস্বরূপ:
যদি একজন সাধারণ করদাতার বার্ষিক আয় হয় ৮,৫০,০০০ টাকা, তাহলে কর হিসাব হবে:
প্রথম ৩,৫০,০০০ → ০%
পরবর্তী ১,০০,০০০ → ৫% = ৫,০০০ টাকা
পরবর্তী ৪,০০,০০০ → ১০% = ৪০,০০০ টাকা
➡️ মোট কর = ৫,০০০ + ৪০,০০০ = ৪৫,০০০ টাকা
ব্যক্তি করদাতার সারচার্জ হার ?
বাংলাদেশে ব্যক্তি করদাতার জন্য সারচার্জ (Surcharge) মূলত উচ্চ আয়ের করদাতাদের জন্য প্রযোজ্য একটি অতিরিক্ত কর। এটি মূল আয়করের উপর নির্দিষ্ট হারে ধার্য করা হয়।
২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের জন্য ব্যক্তি করদাতার সারচার্জ হারঃ
নেট সম্পদের পরিমাণ | সারচার্জ হার |
---|---|
৪ কোটি টাকার বেশি কিন্তু ১০ কোটির কম | ১০% |
১০ কোটির বেশি কিন্তু ২০ কোটির কম | ২০% |
২০ কোটির বেশি কিন্তু ৫০ কোটির কম | ৩০% |
৫০ কোটির বেশি | ৩৫% |
সারচার্জটি মূলত করদাতার মোট আয়করের উপর ধার্য করা হয়, এবং এটি কর রিটার্নে আলাদাভাবে উল্লেখ করতে হয়।
অর্থবছরের জন্য গাড়ির উপর পরিবেশ সারচার্জ কত?
বাংলাদেশে গাড়ির উপর পরিবেশ সারচার্জ মূলত ইঞ্জিন ক্ষমতা (সিসি) অনুযায়ী ধার্য করা হয়।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য গাড়ির উপর পরিবেশ সারচার্জ হারঃ
গাড়ির ইঞ্জিন ক্ষমতা (সিসি) | সারচার্জ হার (করযোগ্য আয়ের উপর) |
---|---|
১৫০০ সিসি পর্যন্ত | ২৫,০০০ টাকা |
১৫০১ – ২০০০ সিসি | ৫০,০০০ টাকা |
২০০১ – ২৫০০ সিসি | ৭৫,০০০ টাকা |
২৫০১ – ৩০০০ সিসি | ১,৫০,০০০ টাকা |
৩০০১ – ৩৫০০ সিসি | ২,০০,০০০ টাকা |
৩৫০০ সিসির বেশি | ৩,৫০,০০০ টাকা |
হাঁস-মুরগীর খামার, হাঁস-মুরগী, চিংড়ি ও মাছের হ্যাচারি (hatchery) এবং ম মৎস্য চাষ হতে আয়ের জন্য হ্রাসকৃত কর হার ?
আয়ের পরিমাণ | করহার |
---|---|
প্রথম ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত | শূন্য (০%) |
পরবর্তী ১০,০০,০০০ টাকা | ৫% |
পরবর্তী ১০,০০,০০০ টাকা | ১০% |
অবশিষ্ট আয়ের ওপর | ১৫% |
কর রেয়াতের জন্য প্রযোজ্য বিনিয়োগ খাত সমূহ কি কি ?
আয়কর রেয়াতের জন্য প্রযোজ্য বিনিয়োগ কিছু খাতসমূহ নিন্মে আলোচনা করা হলঃ
১. সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ : অনধিক ৫ (পাঁচ) লক্ষ টাকা পর্যন্ত সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ;
২. লাইফ ইনস্যুরেন্স প্রিমিয়াম (জীবন বীমা প্রিমিয়াম): লাইফ ইনস্যুরেন্স প্রিমিয়াম প্রদান।
৩. ডিপোজিট পেনশন স্কিম (DPS) : মাসিক সঞ্চয় স্কিম এ অনধিক ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা।
৪. শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ : ধার্যকৃত কোম্পানির শেয়ার বা মিউচ্যুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ।
৫. স্বীকৃত ভবিষ্য তহবিল (Recognized Provident Fund): করদাতা এবং নিয়োগকর্তা কর্তৃক স্বীকৃত ভবিষ্য তহবিল জমা।
৬. ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (ICB): ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ এর মাধ্যমে অনধিক ৫ (পাঁচ) লক্ষ টাকা বিনিয়োগ।
৭. গ্র্যাচুইটি ফান্ড: গ্র্যাচুইটি ফান্ডে অবদান/জমা প্রদান।
উপসংহার
অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল করা এখন আর কঠিন কাজ নয়। সঠিক তথ্য ও দলিল দিয়ে আপনি সহজেই রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন ঘরে বসেই। (তবে সঠিকভাবে রিটার্ন দাখিলের ক্ষেত্রে একজন দক্ষ আয়কর আইনজীবীর সহযোগিতা নিতে পারেন)এই প্রক্রিয়া শুধু করদানের দায়িত্বই পালন করে না, বরং একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে নিজের পরিচয়ও গড়ে তোলে।